বাংলাদেশের ভূমি আইন: ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
মুসলিম যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসন এবং পাকিস্তানি আমল পর্যন্ত ভূমি আইনের বিকাশ, কবুলিয়াত-পাট্টা ব্যবস্থা ও নিস্কর জমির প্রভাব নিয়ে আলোচনা।
বাংলাদেশে বর্তমান ভূমি আইন এক দীর্ঘ ইতিহাসের ফল। মুসলিম, হিন্দু এবং ব্রিটিশ শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভূমি প্রশাসনের ধরন বদলেছে, যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি আমলে বিদ্যমান আইনে রূপ নিয়েছে। আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে এই ধারাবাহিকতা বোঝা জরুরি।
মুসলিম আমলের ভূমি আইন
মুসলমান শাসকরা ভারত বিজয়ের পর প্রচলিত হিন্দু ভূমি আইন সম্পূর্ণ বাতিল না করে অনেক দিক অনুসরণ করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী, সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলক, সম্রাট শের শাহ ও সম্রাট আকবর ভূমি প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। কবুলিয়াত ও পাট্টা প্রদানের যে পদ্ধতি এখনও দেখা যায় তা শের শাহর উদ্যোগে শুরু হয়, যেখানে অস্থায়ী ভিত্তিতে কৃষকদের মালিকানা দেওয়া ও নির্দিষ্ট হারে খাজনা ধার্য করা হতো। আকবর এই ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যে ন্যায়সঙ্গত ভূমি ও রাজস্ব নীতি প্রয়োগ করেন।
নিস্কর বা লাখেরাজ ভূমি
মুসলিম শাসনামলে বাদশাহর অনুগত ব্যক্তিদের নিস্কর বা লাখেরাজ ভূমি দান করার প্রচলন ছিল। ইংরেজ শাসন শুরু হলে এসব নিস্কর জমির উপর কর আরোপ করা হয়, ফলে অনেক পুরনো দানভিত্তিক জমি খাজনার আওতায় আসে।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমল
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চল প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনে ছিল। ব্রিটিশ আমল থেকেই আধুনিক ভূমি আইনের কাঠামো তৈরি হয় এবং পাকিস্তানি আমলে তা কার্যকর থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের বিদ্যমান ভূমি আইন মূলত এই পাকিস্তানি যুগের উত্তরাধিকার।
হিন্দু আমলের ভূমির ধারা
হিন্দু আমলে ভূমির একক মালিকানা ছিল না। জনসংখ্যা কম থাকায় অনেক জমি অনাবাদী থাকত এবং যে জমি কেউ চাষ করে উর্বর করত সে-ই কার্যত মালিক হতো। জমির উৎপাদন তিন ভাগে ভাগ করে কৃষক, গ্রাম প্রধান এবং রাজার মধ্যে বিতরণ করা হতো। জমি কেনাবেচার তেমন প্রচলন ছিল না; বরং গ্রাম্য প্রথা ও ব্রাহ্মণ নেতৃত্বাধীন সামাজিক রীতিনীতিই আইনরূপে বিবেচিত হতো।
এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানলে বর্তমান ভূমি নীতি ও প্রশাসনের পেছনের ধারাবাহিকতা বোঝা সহজ হয়, এবং নাগরিকরা আইন সম্পর্কে সচেতন হয়ে নিজেদের অধিকার সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন।