ভূমি রেকর্ডভূমি গাইড

ভূমি জরিপ/রেকর্ড ও বিবিধ বিষয়াদি

October 19, 2025 ৯ মিনিটের পড়া Mouza Map টিম

তৌজি, খতিয়ান, মাঠ পর্চা থেকে নামজারী ও বিশেষ জমির শ্রেণীবিভাগ—ভূমি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ শব্দভাণ্ডার এক নজরে।

ভূমি জরিপ, রেজিস্ট্রেশন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে বহু বিশেষ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়। এসব শব্দের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ব্যবহারিক অর্থ বোঝা না গেলে জমি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে ভুল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। নিচে জরিপ ও রেকর্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলোর পরিচয় তুলে ধরা হলো।

প্রশাসনিক ও জরিপ পরিভাষা

  • তৌজি: ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর কালেক্টরেটে রক্ষিত ভূমি রেজিস্টারের ক্রমিক নম্বরকে তৌজি বলা হয়। জমিদারের অধীনে প্রজার জোতও এই তৌজি নম্বরে অন্তর্ভুক্ত থাকত।
  • জে.এল নম্বর (Jurisdiction List): একটি উপজেলা বা থানার অধীন মৌজাসমূহের ধারাবাহিক পরিচিতিমূলক ক্রমিক নম্বর।
  • মৌজা: জরিপ পরিচালনার ক্ষুদ্রতম ভৌগলিক ইউনিট; সাধারণত একটি ইউনিয়নকে একাধিক মৌজায় ভাগ করে জরিপ করা হয়।
  • পরগনা: ঐতিহাসিকভাবে জমিদারের আওতাধীন বিস্তীর্ণ এলাকা।
  • বাটা দাগ: নকশায় বাদ পড়া প্লট চিহ্নিত করতে ভগ্নাংশের মতো নম্বর ব্যবহার করে যে বিশেষ দাগ নম্বর দেয়া হয়।
  • ছুটা দাগ: জরিপ নকশা প্রস্তুতকালে ভুলবশত বাদ পড়া কিংবা পরবর্তীতে একত্রিত দাগ থেকে বাদ চলে যাওয়া নম্বর।
  • গান্টার চেইন: ভূমির দৈর্ঘ্য পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত ১০০ লিংক বিশিষ্ট ৬৬ ফুট দীর্ঘ চেইন।

খতিয়ান ও নামজারী সংক্রান্ত শব্দ

  • খতিয়ান: এক বা একাধিক দাগের ভূমি নিয়ে মালিকানা স্বত্বের সরকারি নথি।
  • সি.এস খতিয়ান: ১৮৯০ দশকে ব্রিটিশ জরিপে প্রস্তুত প্রাথমিক খতিয়ান।
  • এস.এ খতিয়ান: ১৯৫৬-৬০ সালে রাষ্ট্র অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে প্রস্তুত খতিয়ান।
  • আর.এস খতিয়ান: পূর্বের খতিয়ানের ভুল সংশোধনে বাংলাদেশ সরকারের সংশোধিত জরিপ নথি।
  • বি.এস খতিয়ান/সিটি জরিপ: ১৯৮৮ সাল থেকে চলমান সর্বশেষ নগর ও গ্রামীণ জরিপ নথি।
  • খানাপুরি: জরিপ শেষে খতিয়ান ফর্মের প্রতিটি কলাম পূরণের প্রক্রিয়া।
  • নামজারী: উত্তরাধিকার বা অন্যান্য সূত্রে জমির মালিকানা পরিবর্তনের পরে সরকারি খতিয়ানে নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করা।
  • তফসিল: জমির পরিচিতি, দাগ, খতিয়ান, পরিমাণ ও চৌহদ্দি বিস্তারিত বিবরণ।
  • পর্চা ও মাঠ পর্চা: চূড়ান্তখতিয়ানের অনুলিপি এবং তসদিকের আগে মালিকদের দেয়া খসড়া অনুলিপি।
  • চিটা/চিটা দাগ: আদালত নিযুক্ত কমিশনারের সরেজমিন পরিমাপে প্রস্তুত খসড়া ম্যাপ বা দাগ তালিকা।
  • বায়া দলিল: জমি যতবার হস্তান্তর হয়েছে তার পূর্ববর্তী প্রতিটি নিবন্ধিত দলিল; মালিকানার ধারাবাহিকতা যাচাইয়ের মূল উপাদান।

জমি অধিগ্রহণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা

  • ভূমি অধিগ্রহণ: জনস্বার্থে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক সম্পত্তি গ্রহণ।
  • বারবরদারী খরচ: দলিল দাতা অফিসে আসতে না পারলে কর্মকর্তার গমনাগমনের ব্যয়।
  • বয়নামা: আদালত কর্তৃক নিলাম বিক্রয় চূড়ান্ত হলে ক্রেতাকে প্রদত্ত সনদ।
  • দখলনামা: নিলাম ক্রেতাকে সরকারি পক্ষ থেকে দখল বুঝিয়ে দেয়ার সনদ।
  • জমাবন্দি: জমিদারি আমলে প্রজার নাম, জমি ও খাজনার বিবরণী; বর্তমানে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অনুরূপ রেকর্ড রাখা হয়।
  • আমলনামা: জমিদার কর্তৃক প্রজাকে প্রদানকৃত জমি বন্দোবস্তের নথি।
  • তলববাকী: হোল্ডিংভিত্তিক জমি উন্নয়ন করের হাল ও বকেয়া দাবি তালিকা।
  • মিনাহ: সিকস্তি বা অধিগ্রহণের ফলে জমির পরিমাণ কমলে খাজনা হ্রাসকরণ।
  • তহসিলদার: অতীতে রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তা; বর্তমানে উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা।
  • কোর্ট অব ওয়ার্ডস: অবিভাবকহীন বা নাবালক উত্তরাধিকারীর জমিদারি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে পরিচালনার ব্যবস্থা।

জমির শ্রেণী ও ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য

  • চালা/ভিটি: উঁচু জমি যেখানে সাধারণত আবাদ বা বসতি স্থাপন করা হয়।
  • ছড়া/ছড়ি: পাহাড় বা টিলার ঢালু জমি যা নিচু ভূমির দিকে নেমে আসে।
  • নয়নজুলি: রাস্তার দুই পাশে খননকৃত নালা।
  • বাওড়, হাওড়, বিল, ঝিল: নদীপথ পরিবর্তন বা বর্ষার পানিতে সৃষ্ট নানা ধরনের জলাভূমি।
  • হালট: মাঠে যাতায়াতের জন্য রাখা সরু পথ।
  • আইল: জমির সীমানা নির্দেশক উঁচু অংশ বা বাঁধ।
  • সিকস্তি: নদী বা সাগরে ভেঙ্গে যাওয়া ভূমি।
  • পয়স্তি: পূর্বে ভেঙ্গে যাওয়া ভূমি পুনরায় চর হয়ে জেগে ওঠা।
  • গোপাট/গোচর/গোবাম: গবাদি পশুর চরাগাহ।
  • ডাঙ্গা জমি, নাল জমি, কোলা জমি: দলিলে ব্যবহৃত উচ্চ, নিম্ন ও বসতসংলগ্ন জমির শ্রেণীবিভাগ।
  • চটান, ভটি জমি, পানাম ভূমি: বাড়ি সংলগ্ন উঁচু পতিত বা সবজি চাষের উপযোগী জমি।

বিশেষ সম্পত্তি ও ধর্মীয় বন্দোবস্ত

  • অর্পিত সম্পত্তি: পাকিস্তানি নাগরিকের ফেলে যাওয়া শত্রু সম্পত্তি যা স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের অধীনে আসে।
  • বিনিময় সম্পত্তি: ১৯৪৭ সালের দেশভাগে আগত ও প্রবাসী নাগরিকদের মধ্যকার সম্পত্তি বিনিময়।
  • পরিত্যক্ত সম্পত্তি: মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে স্থায়ীভাবে দেশছাড়া পাকিস্তানি নাগরিকের সম্পত্তি।
  • ওয়াকফ সম্পত্তি: ধর্মীয় বা সমাজকল্যাণমূলক কাজে উৎসর্গীকৃত স্থাবর সম্পত্তি; তত্ত্বাবধায়ক মোতওয়াল্লী।
  • দেবোত্তর সম্পত্তি: হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যয়ের জন্য উৎসর্গকৃত ভূমি; তত্ত্বাবধায়ক সেবায়েত।
  • এজমালী সম্পত্তি: একাধিক শরিকের যৌথ দখলে থাকা জমি।
  • চাকরান ভূমি: জমিদার কর্তৃক চাকরের পরিচর্যার বিনিময়ে দেয়া জমি।
  • বর্গা চাষী: ফসলের ভাগের ভিত্তিতে ভূমি আবাদকারী ব্যক্তি।

রাজস্ব ও আর্থিক দলিল

  • দাখিলা: ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের পর তহসিল অফিসার প্রদত্ত রশিদ।
  • ডি.সি.আর (Duplicate Carbon Receipt): ভূমি কর ছাড়া অন্যান্য সরকারি পাওনা আদায়ের রশিদ।
  • সায়রাত মহল: বিল, হাওড়সহ সাধারণ ব্যবহার্য স্থানের সাময়িক লিজ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব।
  • জলকর ও জলমহাল: জলমগ্ন স্থান ইজারা দিয়ে আদায়কৃত কর ও সংশ্লিষ্ট মৎস্য আহরণের এলাকা।
  • নজরানা ও সালামি: জমিদারের কাছ থেকে জমি পত্তন বা স্থায়ী ইজারার প্রিমিয়াম।
  • হাসিল: গবাদি পশুর হাটে লেনদেনের উপর আদায়কৃত টোল।

ঐতিহ্যবাহী শব্দ ও সংক্ষিপ্ত রূপ

  • কায়েমী স্বত্ব: স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রাপ্ত ভূমির স্বত্ব।
  • মৌরশী: পুরুষানুক্রমিক ভোগদখল বা উত্তরাধিকারী স্বত্ব।
  • মুদাফৎ: যার নামে প্রথম কোনো জোতের সৃষ্টি হয়।
  • রায়ত: দখলী স্বত্বসম্পন্ন প্রজা।
  • দওল/পতনি/প্রজাবিলি: বিভিন্ন ধরনের সাময়িক বা স্থায়ী বন্দোবস্তকৃত জমির শ্রেণী।
  • মোয়াজি: মোট ভূমির পরিমাণ।
  • স্থিতিবান: স্থায়ী স্বত্বধারী রায়ত।
  • মহল: রাজস্ব আদায়ের নির্দিষ্ট এলাকা বা ইউনিট।
  • ইজা: পূর্বের হিসাব থেকে স্থিত টেনে আনা বা চলমান অবস্থা।
  • কান্দা: উচ্চ ভূমি নির্দেশক শব্দ।
  • হেবা: দান, লিবি: বন্ধক, খিরাজ: খাজনা, কিতা: দাগ/প্লট, বিতং: বিস্তারিত, লাখেরাজ: নিস্কর জমি।
  • দোং (দোহিতা), জং (জওজিয়তে), আং (আহলিয়ে), মং (মবলগে), সাং (সাকিন): পুরোনো দলিলে ব্যবহৃত সংস্কৃত/ফারসি/আরবি উৎসের সংক্ষিপ্ত রূপ।

এই শব্দগুলোর প্রায় প্রতিটির পেছনে রয়েছে নির্দিষ্ট আইনি প্রেক্ষাপট বা রাজস্ব প্রশাসনের নিয়ম। নথি পড়ার সময় পরিভাষা বোঝা গেলে জমি ক্রয়, নামজারী বা বিরোধ নিষ্পত্তি অনেক সহজ হয়।