আইনগত নির্দেশিকাভূমি গাইড

জমি ক্রয় বিক্রয়ের সতর্কতা

October 13, 2025 ৮ মিনিটের পড়া Mouza Map টিম

দলিল সম্পাদনের আগে খতিয়ান, দাগ, খাজনা, আইনগত সীমাবদ্ধতা ও মালিকানার ধারাবাহিকতা যাচাইয়ের পূর্ণাঙ্গ চেকলিস্ট।

জমি ক্রয়ের আগে কয়েকটি মৌলিক সতর্কতা অনুসরণ করলে প্রতারণা বা আইনি জটিলতা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। ক্রেতাকে বুঝতে হবে—কেবল প্রকৃত মালিকই তার ভূমি হস্তান্তর করতে পারেন; তাই মালিকানা ও দখলীয় স্বত্ব বৈধ নথিতে প্রমাণিত কিনা তা যাচাই করা অপরিহার্য।

হস্তান্তরকারী পক্ষের কাগজপত্র, রেকর্ড এবং নামজারী প্রক্রিয়ায় সামান্য অবহেলাই ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। নীচের ধাপগুলো ক্রমানুসারে অনুসরণ করলে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ঝুঁকি অনেক কমে।

প্রাথমিক যাচাই

  1. বিক্রীত ভূমির সংশ্লিষ্ট খতিয়ানে বিক্রেতার নাম আছে কিনা নিশ্চিত করুন।
  2. যদি বিক্রেতার নাম খতিয়ানে না থাকে, তবে তার স্বত্ব বৈধ দলিল বা আদালতের ডিক্রি দ্বারা প্রমাণ করতে বলুন।
  3. ভূমির মৌলিক তথ্য—মৌজা, খতিয়ান, দাগ, মোট পরিমাণ এবং বিক্রেতার অংশ—ক্রয়ের আগে সব কাগজপত্রে মিলিয়ে নিন।
  • ভূমিটি কোন মৌজায় অবস্থিত
  • কোন খতিয়ান ও দাগ নম্বরের মধ্যে পড়ে
  • উক্ত দাগে জমির মোট পরিমাণ কত
  • খতিয়ানে বিক্রেতার অংশ বা হিস্যা অনুযায়ী জমির পরিমাণ কত
  • সংশ্লিষ্ট নকশা বা ম্যাপে অবস্থান সঠিকভাবে উল্লেখ আছে কি না

ক্রয় দলিল মিলিয়ে দেখা

খতিয়ানভুক্ত মালিক থেকে বর্তমান বিক্রেতা পর্যন্ত মালিকানার ধারাবাহিকতা পরিষ্কার না হলে দলিলের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাই প্রতিটি দাতা ও গ্রহীতার তথ্য, সংশ্লিষ্ট দাগ ও আয়তনের সাথে বর্তমান দলিলের মিল থাকা জরুরি।

  1. দলিলে উল্লেখিত দাতা ও জমির বিবরণ সংশ্লিষ্ট খতিয়ানে রয়েছে কিনা যাচাই করুন; না থাকলে তাদের স্বত্ব কীভাবে এসেছে তা প্রমাণকারী নথি দেখুন।
  2. খতিয়ানভুক্ত মালিক কর্তৃক বিক্রির পর যতবার জমি হাতবদল হয়েছে তার ধারাবাহিক দলিল (পিট দলিল) সংগ্রহ করে পরীক্ষা করুন।
  3. সাবেক খতিয়ান ও দাগ নম্বর বর্তমানে কোন হাল খতিয়ান ও দাগে রূপান্তরিত হয়েছে তা মিলিয়ে নিন।
  4. বিক্রয়ের পরে ক্রেতা নামজারী করেছে কি না এবং বিক্রেতা একই জমি গোপনে অন্যকে বিক্রি করেছে কি না অনুসন্ধান করুন।
  5. জমিটি বর্তমানে কার দখলে রয়েছে তা সরেজমিনে যাচাই করুন।

খাজনা ও প্রশাসনিক অনুসন্ধান

  1. বকেয়া ভূমি খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন করের জন্য জমি নিলামে বিক্রি হয়েছে কি না বা সরকার খাস করেছে কি না নিশ্চিত করুন।
  2. দীর্ঘদিন খাজনা অনাদায়ী থাকলে বা মারফতদার কর্তৃক খাজনা পরিশোধ হলে তহসিল অফিস থেকে প্রকৃত মালিকানার অবস্থা জেনে নিন।
  3. অপরিশোধিত খাজনার কারণে জমি নিলামে খাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না তহসিলে অনুসন্ধান করুন।

বিশেষ আইন ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ

  1. পরিত্যক্ত বা অর্পিত ও অনাবাসী সম্পত্তি (পরিত্যক্ত হিন্দু মালিকের জমি) হিসেবে তালিকাভুক্ত কি না যাচাই করুন।
  2. ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতা করে দেশত্যাগকারী মালিকের (পি-ও ১৬/৭২) সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে কি না পরীক্ষা করুন।
  3. Test Acquisition and Tenancy Act-এর ৯৭ ধারা অনুযায়ী আদিবাসী মালিকের জমি হলে রেভিনিউ অফিসারের লিখিত সম্মতি রয়েছে কি না নিশ্চিত করুন।
  4. প্রেসিডেন্ট আদেশ নং ৯৮/৭২ এবং ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ অনুসারে ৬০ বিঘার সীমা অতিক্রম করে জমি ক্রয় হচ্ছে কি না পরীক্ষা করুন; সীমা লঙ্ঘিত হলে জমি বাজেয়াপ্ত হতে পারে।

দলিল প্রস্তুতের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা

  1. দলিলে ভায়া দলিলের নম্বর, দাতা-গ্রহীতার নাম ও প্রাসঙ্গিক কাগজপত্রের বিবরণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে কি না নিশ্চিত করুন।
  2. দলিলের তফসিলে জেলা, থানা, মৌজা, খতিয়ান, দাগ, জমির মোট পরিমাণ, কাতের তথ্য এবং শহরাঞ্চলে রাস্তা বা পৌর নম্বরসহ সব চৌহদ্দি ঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে কি না যাচাই করুন।

এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিটি পর্যায়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখা যায়। ফলে মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, প্রতারণা কিংবা প্রশাসনিক জটিলতায় পড়ার ঝুঁকি কমে যায়।