আইনগত নির্দেশিকাভূমি গাইড

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

October 23, 2025 ৯ মিনিটের পড়া Mouza Map টিম

দায়ভাগ পদ্ধতির সপিণ্ড, সকুল্য, সমানোদক উত্তরাধিকার, জীবন স্বত্ব ও স্ত্রীধনের অধিকারসহ হিন্দু উত্তরাধিকার ব্যবস্থার মূল ধারণা।

হিন্দু ধর্ম বহু প্রথা ও বিশ্বাসের সমষ্টি; সিন্ধু সভ্যতা থেকে বর্তমান পর্যন্ত স্থান-কাল ভেদে এই বিশ্বাস ও রীতির বৈচিত্র্য দেখা যায়। তাই হিন্দু উত্তরাধিকার আইনও মূলত প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান ও কোর্টের পূর্বের রায়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

হিন্দু আইন কাদের উপর প্রযোজ্য

হিন্দু আইন প্রযোজ্য হয় জন্মসূত্রে হিন্দু ব্যক্তির উপর, হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত ব্যক্তির উপর, হিন্দু পিতা-মাতার অবৈধ সন্তানের উপর এবং পিতা খ্রিস্টান ও মাতা হিন্দু হলে যদি সন্তান মায়ের কাছ থেকে হিন্দু আচার অনুযায়ী লালিত হয়। এ আইন কোনো ব্যক্তির সৃষ্ট নয়; যুগ যুগ ধরে প্রথা ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি পরিণতি লাভ করেছে।

বাংলাদেশে এই আইনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সীমিত; আদালত প্রায়ই পূর্বতন রায়কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। ভারতে সাম্প্রতিক সংশোধন থাকলেও দায়ভাগ পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে কার্যকর।

দায়ভাগ বনাম মিতাক্ষরা

হিন্দুদের মধ্যে মূলত দুটি উত্তরাধিকার পদ্ধতি চালু—দায়ভাগ এবং মিতাক্ষরা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে দায়ভাগ প্রচলিত, আর ভারতের অবাঙালি সমাজে মিতাক্ষরা। দায়ভাগ মতে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধে পিণ্ডদানের অধিকারী ব্যক্তিই উত্তরাধিকারী হন।

দায়ভাগে উত্তরাধিকার শ্রেণী

  • সপিণ্ড: প্রথম শ্রেণী; নিকটবর্তী উত্তরাধিকারী যারা পরস্পরকে পিণ্ড দান/গ্রহণ করতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে ৪৮ জন পর্যন্ত হলেও বাস্তবে ~২০ জন। মহিলা সপিণ্ড ৫ জন—বিধবা স্ত্রী, কন্যা, মাতা, পিতার মাতা, পিতামহী—যারা জীবন স্বত্বের অধিকারী।
  • সকুল্য: দ্বিতীয় শ্রেণীর উত্তরাধিকার; পিতামহের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষের উত্তরাধিকারীরা এখানে অন্তর্ভুক্ত, মোট সদস্য ৩৩ জন।
  • সমানোদক: তৃতীয় ও দূরবর্তী শ্রেণী; ঊর্ধ্বতন সাত পুরুষের উত্তরাধিকারী যারা শ্রাদ্ধে পিণ্ডজল প্রদান করে। এদের সংখ্যা ১৪৭ জন এবং নারী এতে অন্তর্ভুক্ত নয়।

জীবন স্বত্ব ও নারী উত্তরাধিকার

দায়ভাগে স্ত্রী, কন্যা বা মাতা সম্পত্তি পুরোপুরি ভোগান্ত করতে পারে না; তারা জীবন স্বত্বের অধিকারী। অর্থাৎ যতদিন বেঁচে থাকেন ততদিন সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন কিন্তু বিক্রি বা দান করতে পারেন না, ব্যতিক্রম হিসেবে শ্রাদ্ধের খরচ, নাবালক সন্তানের শিক্ষাব্যয় ইত্যাদির জন্য সীমিত হস্তান্তর সম্ভব। তাদের মৃত্যুতে সম্পত্তি মূল উৎসের অন্যান্য উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরে যায়।

স্ত্রীধন ধারণা

স্ত্রীধন হলো নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যক্তিগত সম্পত্তি—উপহার, যৌতুক বা নিজস্ব আয়ে অর্জিত সম্পদ। এর উপর নারী সম্পূর্ণ অধিকার ভোগ করে এবং তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা বন্টন পায়। সমাজে যৌতুক প্রথা বিস্তারের পেছনে এই স্ত্রীধনের ধারণা ও বাস্তবতা আংশিক ভূমিকা রাখে।

দায়ভাগের সাধারণ নিয়ম

  1. পিতার মৃত্যুর মুহূর্ত থেকেই উত্তরাধিকার কার্যকর হয়; ভবিষ্যতে সন্তান জন্মের সম্ভাবনায় বণ্টন স্থগিত রাখা যায় না।
  2. পুত্রগণ পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভ করে এবং যৌথ পরিবার গঠন করতে পারে। যৌথ পরিবারের কর্তা প্রয়োজনে সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় বা বন্ধক দিতে পারে।
  3. মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও পুত্র থাকলে স্ত্রী পুত্রের সমান অংশ পায়, তবে জীবন স্বত্বের সীমাবদ্ধতা বজায় থাকে।
  4. একাধিক কন্যার ক্ষেত্রে কেবল কুমারী কন্যা অংশ পায়; বিবাহিত নিঃসন্তান কন্যা পায় না, কিন্তু কন্যার গর্ভজাত পুত্র (দৌহিত্র) উত্তরাধিকারী হতে পারে।
  5. স্বামী মারা গেলে স্ত্রী জীবন স্বত্ব ভোগ করে এবং তার মৃত্যুর পরে সম্পত্তি পুনরায় পুত্রদের মধ্যে বণ্টিত হয়।
  6. বণ্টনের সময় কোনো অংশীদার মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীরা তার অংশের দাবিদার হয়।
  7. দত্তক পুত্র স্বাভাবিক পুত্রের এক-তৃতীয়াংশ অংশের অধিকারী।
  8. কন্যার পুত্র অর্থাৎ দৌহিত্রা মাথাপিছু হারে সম্পত্তি পায়।

দায়ভাগ পদ্ধতিতে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধে পিণ্ডদানের যোগ্যতাই উত্তরাধিকার নির্ধারণের কেন্দ্রে। ফলস্বরূপ নারীর সম্পূর্ণ মালিকানা সীমিত হলেও স্ত্রীধনের মতো প্রথা নারীদের স্বতন্ত্র সম্পত্তি রক্ষার পথ খুলে দেয়।